আমার দাদাজান

ছোটবেলায় আমাদের খুব প্রিয় কাজগুলোর মধ্যে ১টা কাজ ছিল সকালে ঘুম থেকে উঠেই দাদার হাত ধরে মাঠে যাওয়া। মাঠে যাওয়ার ১টাই কারন, দাদার সাথে গেলে ছানা আর মাঠা কিনে খাওয়া হবেই। ছানা আর মাঠার লোভে দাদার হাত ধরে মর্নিং ওয়াক করা। আর কিছুক্ষন পর পর দাদাকে জিজ্ঞাসা করা দাদা আর কতক্ষন হাটবেন? হাটা শেষ হলে অনেক চিনি দিয়ে ছানা…।

শুধু যে সকালবেলাই দাদার সাথে যাওয়া, তা না। স্কুল বন্ধ থাকলে দুপুরে বাজার করতে যাওয়া, সেখানেও দাদা ঘুষ দিয়ে নিয়ে যেত। গেলেই ফার্মেসির দোকান থেকে ১পাতা সিভিট কিনে দিত। বাসায় ফিরে দুপুরে খাবার সময় দাদা যদি ভাত ছেনে না দিত, তাহলে সেই ভাত আমাদের কারো গলা থেকে নামত না। আমি, আমার ছোট দুই চাচাত ভাই, বড় দুই চাচাত বোন এই ৫জন ছিলাম দাদার বাচ্চাপার্টির গ্রুপে। বাইরে কোথাও গেলে কে দাদার হাত ধরবে, এই নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়াও হয়ে যেত। আমরা অবশ্য পালা করে দাদার আঙ্গুল ধরে হাটার সুযোগ পেতাম।

একবার দাদার সাথে দুপুরে একা বাজার করতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক হারিয়ে যাওয়া নয়, দাদা আমাদের ফার্মেসির দোকানে বসায় রেখে বাজার করত, সেবার দাদা আমাকে নিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছিলেন, তখন মনে হয় ক্লাস টুতে পড়তাম। ২ঘন্টা হয়ে গেছে দাদা ফিরছেন না দেখে আমার কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল, পরে সেই দোকানের চাচা আমাকে বাসায় পৌছে দিয়েছিল। বাসায় এসে দেখি আম্মু আর দাদী কান্নাকাটি করছে যে আমাকে বুঝি কোন ছেলেধরা ধরে নিয়ে গেছে। দাদারও মনে ছিল না, আমাকে বসিয়ে দাদা বাজারে গিয়েছিল। আর আম্মুরা ভেবেছিল আমি খেলতে গেছি রাস্তায় আর আমাকে ছেলেধরা ধরেছে। আমাকে বাসায় আনার সাথে সাথে যখন আম্মুরা জানতে পারলো যে আমি দাদার সাথে ছিলাম আর দাদা আমাকে ভুলে ফেলে আসছে, সাথে সাথে মাইর শুরু হয়ে গেল আমার উপর, যে আর যাবি দাদার সাথে!!! দাদা দাদির ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। এত মার খাওয়ার পর কিসের কি… ঠিক বিকালে আমি আর দাদা আবার ঘুরতে বের হলাম। তখন থেকেই আব্বু আর দাদা মিলে আমাকে রাস্তা চিনাতে শুরু করলো। আব্বু আমাকে একদিন এক জায়গা নিয়ে চিনায় নিয়ে আসত,আর পরদিন আমাকে সেই জায়গায় নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসত, দেখত আমি ঠিক মতন বাসায় আসতে পারি কি না। আব্বু আশে পাশেই থাকত। কিন্তু লুকায় থাকত, আমি দেখতে পেতাম না। এভাবেই উনারা ২জন আমার সাহস বাড়িয়ে গেছে সব সময়।

বড় হতে শুরু করলাম, দাদার সেই আঙ্গুল আমাদের সবার জন্য ছোট হতে শুরু করলো। আমরা সবাই যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম, দাদাকে সময় দেবার জন্য আলাদা কোন সময় আমাদের ছিল না। এখানে চলে আসার পর দাদা সব সময় চাইত যেন আমি তাকে চিঠী দেই, কিন্তু দাদাকে চিঠীও দেয়া হয়নি কখনো। দাদা কানে কম শুনে বলে ফোনে কথা বলতে চাইতেন না। আজ দাদার শেষ সময়ে দাদা আপনার আঙ্গুল আমি খুব মিস করছি। এখন মনে হচ্ছে যদি ১০-১২বছর পেছনে যেতে পারতাম তাহলে আপনাকে একা হতে দিতাম না।

সময়ের সাথে সাথে আমাদের পরিধী বেড়েছে কিন্তু আপনার জন্য আমরাই সব ছিলাম, সেটা এত দিন বুঝি নি। জানি না দাদা আপনি হাসপাতাল থেকে ফিরতে পারবেন কিনা…। যদি পারেন কথা দিচ্ছি প্রতি মাসে ১টা চিঠি আপনি অবশ্যই পাবেন।

This entry was posted in চিঠি. Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান